স্কিন ডিজিজের উপর একটা
সেমিনারে যোগ দিতে ঢাকা
থেকে কলকাতা যাচ্ছিলাম আমি।
এরকম ট্যুর পেলে সবাই বউ নিয়ে যায়,
আমিও যেতাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তের
ঝগড়াটা মাটি করে দিল সব।
ঝগড়াটা বেঁধেছিল ওর মামাতো
বোনের বিয়ে নিয়ে। ও বলেছে
যাবে, আমি বলেছি সময় নেই। ব্যস,
এখান থেকেই বেঁধে গেল কুরুক্ষেত্র।
আমি খারাপ, আমি স্বার্থপর, আমি
অসামাজিক - আরও কত যে জানা
অজানা তকমা কপালে জুটল তার ঠিক
নেই।
ব্যস, রেগে গেলাম আমিও। আমার বউ
হয়ে আমাকে অপমান! এত বড় সাহস! যাও,
নিলাম না কাউকে, একাই যাব
কলকাতা, কার কি?
আসলে ঐ ঝগড়ার কারণেই মনটা খারাপ
ছিল। ঝগড়াটা আমার সমস্ত
চিন্তাভাবনাকে এমন জট পাকিয়ে
ফেলেছিল যে, প্লেনে পাশের
সহযাত্রীর সাথে আলাপের সুযোগই হয়
নি আমার।
আমাকে অনেকক্ষণ ধরে একমনে মুখ কুঁচকে
চিন্তা করতে দেখে ভদ্রলোক বললেন,
“ভাই, আপনাকে এত Tensed লাগছে
কেন?”
প্রথমবার কথাটা ভালোভাবে শুনতে
পাই নি। তিনি আবার বললেন, “ভাই,
কি এত চিন্তা করছেন?”
কল্পনায় তখন বউ আমার পা জোড়া প্রায়
ধরেই ফেলেছে, কান্নাকাটি ক্ষমা
চাওয়াচাওয়ি প্রায় শুরুই করে
দিয়েছে, এমন সময় ঐ কথায় চটকা
ভেঙ্গে গেল আমার। শব্দের উৎসের
দিকে তাকিয়ে দেখি, স্যুট টাই পরা
বেশ স্মার্ট এক বাঙালি ভদ্রলোক ঈষৎ
হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে
আছেন।
আমি বললাম, “কিছু বললেন?”
তিনি উত্তর দিলেন, “তখন থেকেই
দেখলাম আপনি খুব Tensed। তাই কৌতূহল
হল আরকি। কি ব্যাপার ভাই? কি
হয়েছে?”
আমি ভদ্রলোকের কথা বলার স্টাইলে
চমৎকৃত হলাম। অসাধারণ শুদ্ধ উচ্চারণে
বাংলা বলেন তিনি। তার পোশাক
আশাকও চমৎকার। ধবধবে সাদা শার্ট,
কালো প্যান্ট, চকচকে কালো স্যুট,
আঁচড়ানো চুল। একটা চুলও অবিন্যস্ত নয়
তার। শার্টে সামান্য ভাঁজও দেখলাম
না আমি। তাছাড়া হাতের রোলেক্স
ঘড়িটাও বেশ দামি। বয়স? হবে
চল্লিশের কাছাকাছি।
আমার এই পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করে তিনি
বললেন, “কি দেখছেন?”
আমি বললাম, “আপনার স্ত্রী-ভাগ্য
নিয়ে মনে মনে আফসোস করছি ভাই।
ছেলেরা একা এতটা ফিটফাট হতেই
পারে না, বিশেষ করে সে যদি
বাঙালি হয়”।
আমার কথা শুনে তিনি হা হা করে
হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, “না
ভাই, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি
অবিবাহিত”।
অবাক হলাম। সত্যি অবাক হলাম আমি।
এরকম স্মার্ট টগবগে একজন যুবক, যে কিনা
আবার হাতে রোলেক্স ঘড়ি পরে
প্লেনে করে বিদেশ যাবার সামর্থ্য
রাখে, সে অবিবাহিত হবে কেন? তবে
কি...
ভাবনাটাকে শেষ করতে না দিয়ে
তিনি বললেন, “জানি আপনি কি
ভাবছেন। ভাবছেন, এত ফিটফাট, স্মার্ট
একটা মানুষের বিয়ে হয় নি কেন, তাই
তো?”
নিজের ভাবনাটা এভাবে ধরা পড়ে
যাবে ভাবি নি। লজ্জা পেলাম খুব।
আমার মুখভঙ্গি দেখে উনি বললেন,
“স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনার মনে
অসংখ্য প্রশ্ন জমা হয়েছে। আমাকে
একটা রহস্যময় মানুষ বলে মনে হচ্ছে, তাই
না?”
আমি বললাম, “হুম। আপনার গেটআপ আর
ম্যারিটাল স্ট্যাটাস ম্যাচ করছে না।
দুটো ভিন্ন কথা বলছে”।
তিনি বললেন, “আচ্ছা, আপনি তো
বিবাহিত, তাই না?”
আমি মাথা নাড়ালাম। “হুম”।
“আপনাদের মধ্যে কি রিসেন্টলি ঝগড়া
হয়েছে?”
চমকে উঠলাম। “হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“না, অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম আপনি
একমনে কীসব বিড়বিড় করছেন আর
আঙ্গুলের বিয়ের আংটিটা ঘুরাচ্ছেন।
আর তাছাড়া আপনার আপনার শার্টের
কলারের এক পাশ তেরছাভাবে ভাঁজ
হয়ে আছে, স্যুটটা ভালোভাবে ঝাড়া
হয় নি বোঝা যাচ্ছে, আর হাতঘড়িটার
ব্যাটারি শেষ হয়ে ওটা অচল হয়ে
আছে। এসব দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার
মিলিয়ে নিতে সমস্যা হল না যে
আপনি খুব রিসেন্টলি বউয়ের সাথে
ঝগড়া করে এসেছেন”।
আমি হেসে ফেললাম। “চমৎকার, ভাই।
অসাধারণ আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি”।
“ধন্যবাদ। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি কিছু
মনে করবেন না। আপনার বউকে আপনি
কতটা ভালবাসেন?”
“অনেক ভালবাসি”।
“আর উনি? উনি আপনাকে কতটা
ভালবাসেন?”
“অনেক ভালবাসে”।
“তাহলে আপনারা ঝগড়া করেন কেন?”
“আসলে ভাই”, একটু ভেবে বলি আমি,
“দুইটা মানুষের মনের মিল তো সবসময় হয়
না, তাই না? যখন হয় না তখনই গ্যাঞ্জাম
বাঁধে, বুঝলেন?”
“বুঝলাম। কিন্তু গ্যাঞ্জাম তো আমার
আপনার মধ্যেও বাঁধতে পারে। তাহলে
হোয়াটস সো স্পেশাল এবাউট
ম্যারেজ...আই মিন, লাভ?”
“এখানেই তো লাভের আসল রহস্য
নিহিত, ভাই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ট্রু
লাভ থাকলে গ্যাঞ্জামের পরে দুপক্ষই
দোষ স্বীকার করে। তখন রিলেশন আরও
গাঢ় হয়। আর ট্রু লাভ না থাকলে সম্পর্ক
আরও খারাপ হয়, এমনকি ভেঙ্গেও
যেতে পারে”।
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বললেন, “কতকিছু মিস করে ফেললাম
জীবনের!”
আমি বললাম, “কেন ভাই? জীবনে
আপনি প্রেমে পড়েন নি? কারো
সাথে রিলেশন হয় নি কখনও?”
তিনি বললেন, “প্রেমে ভাই
পড়েছিলাম, জাস্ট ফর ওয়ান্স”।
“তারপর? রিলেশন টিকল না?”
“আসলে, আমাদের মধ্যে কখনই রিলেশন
হয় নি। আই ফেল ইন লাভ উইথ হার, আই
ওয়াজ ম্যাড ফর হার। কিন্তু, পুরোটাই
ছিল একতরফা। ও আমাকে ভালবাসে
নি”।
আমি নড়েচড়ে বসলাম। “কাহিনীটা
ইন্টেরেস্টিং মনে হচ্ছে। আরেকটু বলা
যায় কি?’
তিনি বললেন, “শুনবেন? অন্যের
কচকচানি আজকাল কেউ শুনতে চায়
না”।
আমি বললাম, “আমি শুনব। বলুন আপনার
লাভ স্টোরি”।
ভদ্রলোক শুরু করলেন, “আমি যখন
মেডিকেলে কলেজে থার্ড ইয়ারে
পড়তাম তখন এক সহপাঠিনীর প্রেমে
পড়ে যাই। প্রেম মানে ভয়াবহ প্রেম,
উথাল পাথাল প্রেম।
একদিন ওকে না দেখলে ভালো লাগে
না, ওর ছবি না দেখলে রাতে ঘুম আসে
না, ওকে অন্য ছেলের আশেপাশে
দেখলে ছেলেটাকে স্রেফ খুন করতে
ইচ্ছা করে...মানে পাগলামি ভর করলে
মানুষের যা হয়, আমার হয়েছিল তাই-ই।
ও আমার দিনের শান্তি তো বটেই,
রাতের ঘুমও হারাম করে দিয়েছিল।
ওকে যে আমার ভালো লাগে সেটা
আমি প্রথমে বন্ধুদের দিয়ে বলাই। পরে
নিজেই বলি। কিন্তু ও আমার প্রস্তাবে
রাজি হয় না। আবার রাজি না হবার
কোন কারণও বলে না মেয়েটা।
আমি পাগলের মত হয়ে যাই। ভালো
স্টুডেন্ট ছিলাম আগে, কিন্তু তখন
থেকে আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিই।
সিগারেট ধরি। আগে পাঁচ ওয়াক্ত
নামাজ পড়তাম, কিন্তু তখন থেকে সব
শিকেয় ওঠে। আগে ছেলেদের সাথে
ভালো মিশতাম, কিন্তু তখন থেকে
কথা না বলার কারণে একের পর এক
ভালো বন্ধু হারাতে থাকি আমি।
আমি হাত কেটে ওকে রক্ত দিয়ে
চিঠি লিখে পাঠাই। ঘুমের ওষুধের
খালি বোতল পাঠাই। কিন্তু ও কোন
উত্তর দেয় না। ভিতরে ভিতরে আমার
পুরনো আমিটা মারা যেতে থাকে।
পরীক্ষা চলে আসে। আমি শুয়ে থাকি,
বসে থাকি। পোলাপান পরীক্ষা
দিতে যায়, আমি পাশ ফিরে শুই।
পোলাপান পরীক্ষা দিয়ে আসে, আমি
ব্রাশে পেস্ট মাখাই। পোলাপান
নেক্সট পরীক্ষার পড়া শুরু করে, আমি
ক্যান্টিনবয়কে ফোন করে আরেক
প্যাকেট সিগারেট রুমে দিয়ে যেতে
বলি।
ভাগ্য সহায়ই বলতে হবে, অবশেষে তার
দয়া হয়। আমার সাথে দেখা করে সে।
কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয় আমার উপর।
এগুলো পূরণ করলে নাকি ও আমাকে
ভালবাসবে।
আমি শর্তগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে
থাকি। ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হয়,
শর্তে যদি থাকে আমাকে এখন সাগরে
ঝাঁপ দিতে হবে তো আমি এখনই ঝাঁপ
দেব। শর্তে যদি থাকে কুমিরের সাথে
খালি হাতে যুদ্ধ করতে হবে তো এখনই
লেগে যাব মরণপণ যুদ্ধে।
কিন্তু শর্তগুলো শুনে আমি হতবাক হয়ে
যাই। ও বলে, “তোমাকে সব সাপ্লি
পরীক্ষা পাশ করতে হবে। নেক্সট যত
আইটেম আছে সব রেগুলার ক্লিয়ার
করতে হবে। প্রত্যেক সাবজেক্টে
টার্মে ভালো মার্কস ক্যারি করতে
হবে, প্লেস করলে তো আরও ভালো।
প্রফে খুব ভালো করতে হবে, ওয়ার্ডে
নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, ওয়ার্ডের সব
দায়িত্ব নিয়মিত পালন করতে হবে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় অবশ্যই নিয়ম করে
পড়তে বসতে হবে।
এখন থেকে সিগারেট নিষেধ, তাস
নিষেধ, রাত জেগে আড্ডাবাজি
নিষেধ। প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ
পড়তে হবে, দৌড়াতে হবে, গোসল করে
ক্লাসে আসতে হবে। নিজের বিছানা
ও পোশাক আশাক সবসময় ফিটফাট
রাখতে হবে। চুল আঁচড়াতে হবে,
কাটতে হবে নিয়মিত।
বাবা-মার সাথে প্রতিদিন কমপক্ষে
দুবার ফোনে কথা বলতে হবে। বাবা-
মা কল দিলে যত বড় কাজই থাকুক না
কেন ধরতে হবে, মিসকল দিলে দেখার
সাথে সাথে ব্যাক করতে হবে। সব
আত্মীয় স্বজনকে সপ্তাহে অন্তত একবার
ফোন দিয়ে খবর নিতে হবে। এই
কাজগুলো পুরো এক বছর ধরে যদি করতে
পার, তবেই আমি তোমাকে ভালবাসব”।
বুঝতেই পারছেন ভাই, আমি এই শর্তগুলো
শুনে পুরো থতমত খেয়ে যাই। আমি
স্বপ্নেও ভাবি নি ও এই জাতীয় কোন
শর্ত দেবে। ও চায় আমি যেন একদিনেই
মিস্টার পারফেক্ট হয়ে যাই। কিন্তু যে
ছেলে একবার ছন্নছাড়া জীবনের স্বাদ
পেয়েছে, তার পক্ষে এক দিনেই মি.
পারফেক্ট হয়ে যাওয়া একটু কঠিন বইকি।
কিন্তু ঐ যে কথায় বলে, ভালবাসার
জন্য মানুষ সব করতে পারে? বিশ্বাস
করবেন কি না জানি না, আমি পরদিন
থেকেই একদম ভালো হয়ে গেলাম।
নিয়মিত ক্লাসে যাই, আইটেম দিই,
টার্ম দিই। আম্মাকে আগে তিনদিনে
একবার ফোন দিতাম, এখন দিনে
তিনবার ফোন দিই। তাসের প্যাকেট
ডাস্টবিনে ফেলে দিই, সিগারেট
কাটি কুটি কুটি করে। সবাই আমাকে
দেখে অবাক হয়ে যায়।
টার্মে আমি দুই সাবজেক্টে ফার্স্ট হই।
বাকিগুলোতেও খারাপ করি না। স্পষ্ট
বুঝতে পারি, আমার প্রতি সবার
দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে দ্রুতই।
এখন আর বন্ধুরা দেখলেই অশ্লীল কোন
কথা বলে আড্ডাবাজি শুরু করে দেয়
না। মেয়েরা দেখলেই মুখ বাঁকিয়ে
উলটো ঘুরে চলে যায় না। ব্যাচ
টিচাররাও অচিরেই আমাকে মার্ক
করা শুরু করেন, আমার আইটেম খারাপ
হলেই মনে করেন মহাপ্রলয় ঘটেছে।
প্রফ আসে। একাধিক সাবজেক্টে
অনার্স পেয়ে প্লেস করে বসি আমি।
বাবা-মার মুখে ফোটে অপার্থিব
হাসি। হাসি ফোটে বন্ধুদের মুখেও। শুধু
আমিই মুখ গোমড়া করে বসে থাকি।
অবশেষে শেষ হয় এক বছরের টাইমলাইন।
এক বুক আশা আকাঙ্ক্ষা সঙ্গী করে ওর
মুখোমুখি হই আমি।
ও বলে, “তুমি আসলেই একজন অসাধারণ
মানুষ। কিন্তু...একটা কথা জানা উচিৎ
তোমার”।
বুকের মধ্যে ছ্যাত করে ওঠে আমার।
“কি?”
ও বলে, “বছরখানেক আগে আমার
এনগেজমেন্ট হয়েছিল। এক মাস আগে
সেই মানুষটার সাথে আমার বিয়ে
হয়েছে। তোমাকে আগেই জানানো
উচিৎ ছিল, কিন্তু জানাই নি। ইন
ফ্যাক্ট, আমি আর আমার রুমমেট ছাড়া
কলেজের আর কেউ ব্যাপারটা জানে
না। আই অ্যাম সরি। তুমি আমাকে ক্ষমা
কোর”।
আমার স্বপ্নের পৃথিবী ছারখার হয়ে
যায়। ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন যেন জট
পাকিয়ে যায়। হঠাৎ করে আমার মনে
হয়, আমার পায়ের নিচে যেন মাটি
নেই, আমার যেন কোন অবলম্বন নেই,
আমি যেন পড়ে যাচ্ছি নিঃসীম
শূন্যে, বিলীন হয়ে যাচ্ছি অতল
অস্তিত্বহীনতায়।
আমি ভাঙ্গা গলায় বলি, “তুমি
আমাকে আগে বল নি কেন?”
ও বলে, “সব মানুষ একরকম না। সবার
ভালবাসার বহিঃপ্রকাশও একরকম না।
আরও বড় হও, আমার কথাটার অর্থ বুঝতে
পারবে। আই অ্যাম সরি, চলি”।
ও আমাকে হতবাক করে সেদিন চলে
যায়। ওর সাথে আমি আর জীবনেও কথা
বলি নি। মেডিকেল থেকে বের হবার
পর আর ওর সাথে দেখা হয় নি আমার।
কবে যেন শুনেছিলাম ওর বর স্কিনের
অনেক বড় ডাক্তার, ওরা নাকি অনেক
সুখে আছে।
ভাই, সেদিনের পর থেকে আমার আবার
নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। বই ছেড়ে
আকণ্ঠ ডুবে থাকা উচিৎ ছিল মদ আর
গাঁজায়। রুমে বসানো উচিৎ ছিল জুয়ার
আড্ডা। একগাদা ঘুমের ওষুধ গেলার কথা
ছিল, হয়তো নিজের গলায় নিজেই
একটা পোঁচ বসানোর কথা ছিল আমার।
কিন্তু ভাই জানেন, আমি একটা আশ্চর্য
জিনিস লক্ষ্য করতে থাকি তখন থেকে।
আমি দেখি, সবাই আমাকে সমীহ করে।
ক্লাসের যে ছেলেটা আগে আমাকে
দেখলেই সিগারেট চেয়ে বসত, সে এখন
আমাকে দেখলেই রাস্তা ছেড়ে দেয়।
আগে যে মেয়েটা আমি ঢুকলেই লিফট
থেকে বেরিয়ে যেত, সে এখন
শ্রদ্ধাভরে আমার দিকে তাকায়।
আমার বিপদ আগে কাছের কিছু বন্ধুর
মাথাব্যথার কারণ হত, কিন্তু এখন আমার
সুখ দুঃখের ভাগীদার হতে চায় সবাই।
আমার হাসি সবার মন ভালো করে দেয়,
আমার দুঃখ সবার মুখ থেকে হাসি মুছে
দেয়। আমি এক ব্যাগ রক্ত চাইলে দশ
বারোটা হাত একসাথে আকাশের
দিকে উঠে যায়। আমি প্র্যাকটিকাল
খাতা চাইলে দেবার জন্য তখনই প্রস্তুত
হয়ে যায় সবাই।
বিশ্বাস করেন ভাই, মানুষের এই যে
শ্রদ্ধা, সমীহ আর ভালবাসা, এটার
জন্যেই আমি আবার আমার আগের পুরনো
অন্ধকারে ফিরে যাই নি। আমার
কাছে মনে হয়েছে, এক বছর কঠোর
সাধনা করে, সে যে কারণেই হোক,
আমি নিজেকে যে স্তরে নিয়ে
গেছি, এক মুহূর্তের ঝড়ে কিছুতেই
তাকে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়তে
দেয়া যায় না। কিছুতেই না। আর
তাছাড়া, ও হয়তো এটাই চেয়েছিল।
এটাই হয়তো ওর ভালবাসা, ও হয়তো
আমাকে সফল দেখতে চেয়েছিল,
পারফেক্ট দেখতে চেয়েছিল।
জানেন ভাই, ঠিক সেদিন যতটা
ফিটফাট, যতটা পাংচুয়াল ছিলাম,
এখনও ঠিক ততটাই আছি আমি। জীবনে
এর পুরষ্কার আমি অনেক পেয়েছি।
গাড়ি, বাড়ি, স্ট্যাটাস, সম্মান - কি
নেই আমার জীবনে? নিজের একটা
সংসারও থাকতে পারত আমার, অনেক
মেয়ে এবং মেয়ের বাপই আমার সাথে
সম্বন্ধ করবার জন্য পাগল ছিল, কিন্তু
হৃদয়ের সিংহাসনে একবার যাকে
বসিয়েছি, তার জায়গায় কি আর
কাউকে স্থান দেয়া যায়, বলেন ভাই?
ঐ যে ও বলেছিল না, “সবার
ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ একরকম না”?
আমার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ
হিসেবে অবিবাহিতই রয়ে গেছি
আমি। ওর জায়গায় আর কাউকে কল্পনা
করতেই মাথা কিরকম ঝিম ঝিম করত
আমার, কখনই মাথায় ঐ চিন্তাটা
আসতে দিতাম না আমি। এখনও দিই না।
বিশ্বাস করেন ভাই, এখনও আমি ওকে
আগের মতই ভালবাসি। আজীবন
ভালবাসব। ও আমাকে ভালবেসে
জীবনে সফলতার একটা পথ আমাকে
উপহার দিয়ে গেছে, তার প্রতিদান
না দিলে তো অপরাধ হবে, তাই না
ভাই?”
এতক্ষণ হা করে কাহিনী শুনছিলাম
ভদ্রলোকের। উনার কথা শেষ হতেই প্রশ্ন
করলাম, “আপনি ডাক্তার আগে বলেন
নি কেন? কোন মেডিকেল? কোন
ব্যাচ?”
উত্তর এল, “জি ঢাকা মেডিকেল। K-67
ব্যাচ। ২০০৯ সালে ঢুকেছিলাম”।
“আপনার নাম?”
“রাশেদ। ডাঃ রাশেদ, মনোরোগ
বিশেষজ্ঞ। আপনি?”
“আমিও ডাক্তার। ডাঃ মিরাজ। নাইস টু
মিট ইউ, ম্যান। আমি আপনার চার পাঁচ
বছর সিনিয়রই হব”।
গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। ডাঃ রাশেদ
এসেছেন এক আত্মীয়ের সাথে দেখা
করতে। এয়ারপোর্টের বাইরে রাস্তায়
একটা ট্যাক্সি থামালাম আমরা।
রাশেদকে উঠতে দিলাম প্রথম
ট্যাক্সিটায়। উনি চলে যাবার আগে
বললাম, “আপনার ভালবাসার নামটা
জানতে পারি?”
রাশেদ মুচকি হেসে বললেন, “পারেন।
ওর নাম শম্পা। সাদিয়া আফসানা
শম্পা। দুচোখের মধ্যে একটা তিল আছে,
আজও মনে আছে আমার”।
আমার বুকে কে যেন একটা বড় ধাক্কা
মারল। তবু মুখে ভদ্রতার হাসিটা ধরে
রেখে ভদ্রলোককে বিদায় দিলাম
আমি। ভদ্রলোক চলে গেলেন।
সাথে সাথে পকেট থেকে
মোবাইলটা বের করে অন করলাম আমি।
একটু পরেই কমপক্ষে দশটা মেসেজ এল
মোবাইলে। সবই বউয়ের নাম্বার থেকে।
কিন্তু আমার এখন ওগুলো দেখার সময়
নেই।
বউয়ের এক ক্লাসমেট ডাঃ মনীষার
নাম্বার ছিল আমার কাছে। ফোন
দিলাম। সে ধরে বলল, “কি খবর দাদা,
হঠাৎ মনে পড়ল?”
আমি বললাম, “আচ্ছা মনীষা তোমরা
যেন মেডিকেলের কোন ব্যাচ?”
সে বলল, “সে কি, আপনি ভুলে গেছেন?
২০০৯-১০ এর ব্যাচ, K-67”।
“আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো থেকো,
হ্যাঁ? রাখি”। ফোন রেখে দিলাম
আমি।
একটু পরে বউকে ফোন দিলাম আমি।
দুবার বাজার পর ধরল ও। কাঁদো কাঁদো
অথচ দৃঢ় গলায় বলল, “কোন সমস্যা হয় নি
তো?”
আমি বললাম, “না”।
“ঠিকমত পৌঁছিয়েছ?”
“হ্যাঁ”।
“ট্যাক্সি ঠিক করেছ? ওরা কিন্তু ভাড়া
বেশি চায়”।
“এখনই করব”।
“বাইরের কিছু খাও নি তো? ওদের
পানি কিন্তু অত ভালো না, জার্মস
আছে”।
“না খাই নি”।
“অপরিচিত কারো সাথে খাতির করার
দরকার নেই, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে”।
একটু অপেক্ষা করে ও বলল, “মেসেজ
পেয়েছ?”
“হ্যাঁ পেয়েছি”।
“আমি সরি”।
“না আমি সরি”।
“না তোমার কোন ভুল নেই। আমি সরি”।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা শম্পা...”
“কি?”
“সব মানুষ তো একরকম না, তাই না?”
“না। কেন?”
“সবার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশও তো
একরকম না, তাই না?”
হঠাৎ একদম চুপ হয়ে গেল সে। তারপর বলল,
“এ কথা কেন বলছ?”
“আচ্ছা তুমি আমায় কখনও বল নি কেন...”
নাটকীয়ভাবে থেমে যাই আমি।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে দ্বিধান্বিত
কণ্ঠস্বর, “কি বলি নি?”
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি বলি,
“আমায় এত ভালবাস কেন?
.
#যান্ত্রিক_প্রহেলিকা