মোটরসাইকেলের পেছনে বসে বসে
ভার্সিটিতে যেতে ভালই লাগে ত্রিণার । যদিও
বান্ধবীরা অনেকভাবে ঠাট্টা করে ওকে পঁচায় ।
পঁচানোর কারণ অবশ্য ও নিজে একটা বের করে
নিয়েছে । কারণটা হল মোটরসাইকেলে ওর
সামনে বসা মানুষটা , যাকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ত্রিণার
বড়ভাইয়া বলে ডাকতে হয় ...
...
মায়ের মতে এই ম
কারণে অকারণে বকাবকি করে । বলতে গেলে
ত্রিণার ভাল-লাগার সবকিছুতেই বাধ সাধে । এই যেমন
কদিন আগে ত্রিণার বান্ধবীরা সবাই মিলে একটা
ট্যুরে গিয়েছিল । ত্রিণার খুব ইচ্ছে ছিল ওদের
সাথে যাবার , কিন্তু একমাত্র ভাইয়ার কারণে যাওয়া হল না
।
কি বলল?
বলল , “তোর যদি যেতে এতোই ইচ্ছে হয়
তাহলে আমার সাথে যাবি । আমি তুই আর মা , আমরা
তিনজন মিলে ঘুরতে যাব ওই একই জায়গায় । ”
ভাইয়ার কথা বিশ্বাসযোগ্য । এই একটা ব্যপারে ত্রিণা
দ্বিমত পোষণ করতে পারে না যে, এই ভাইয়াটা এক
কথার মানুষ । জীবনে কখনও ভাইয়া নিজের কোন
কথার বরখেলাপ করেনি , তা যত ছোট ব্যাপারই
হোক না কেন ।
আর ত্রিণার ব্যাপারে ?
পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে , কিন্তু ত্রিণা যদি
একটা কিছু চায় সেটা একেবারে সময়মত ওর কাছে
পৌঁছে যাবে ।
কিন্তু অতকিছু ওর লাগবে না । ওর দরকার একটু
হেসে
যেমনই হোক বাইরে লিমার সাথে সবসময়ই ভাল
ব্যবহার করে , হেসে কথা বলে । অন্তত
বান্ধবীদের সামনে ওর মান-সম্মানটুকু রাখে ।
কিন্তু ওর বড়ভাই ?
কোনদিন ওর বান্ধবীদের সাথে একটু হেসে
কথা বলেছে , এমন কাহিনী ঠাকুরমার ঝুলিতেও
পাওয়া যাবে কিনা স্বন্দেহ আছে । এমনকি সালাম
দিলে তার উত্তরেও শুধু মাথাটা উপর নিচ করে চলে
যায় ।
...
যাই হোক, ভাইয়ার কথা বলতে গেলে শুধু বলতেই
হবে । আর শেষ হবে না । প্রতিদিনের মত আজও
ভাইয়ার সাথে ভার্সিটি গেট পর্যন্ত দিনের সবচেয়ে
বোরিং জার্নিটা শেষ করল ত্রিণা । মোটরসাইকেল
থেকে নেমে যাওয়ার সময় ভাইয়া হঠাৎ ডাক দিল ,
-“ত্রিণা”
-“জ্বী ভাইয়া”
-“এদিকে আয়”
... ত্রিণা ভাইয়ার সামনে গেল । তারপর ভাইয়া ত্রিণার
ডানপাশের ঝুঁটিটা ধরে টেনেটুনে ঠিক করে দিল ।
আর বলতে লাগল , “ভার্সিটিতে উঠে গেলি এখনও
চুলের ঝুঁটিটাও ঠিকমত বাঁধতে শিখলি না”
ওহ! বলতে ভুলেই গেছি । ত্রিণাকে একমাত্র ওর
বড়ভাইয়ের জন্যই এখনও এই বয়সে চুলে ঝুঁটি
বেধে ভার্সিটিতে আসতে হয় । এটাও বলা চলে
ভাইয়ার এরেকটা অত্যাচার ওর উপরে । ক্লাসের
ছেলে গুলো রীতিমত ওকে “লাল ঝুঁটি কাঁকাতুয়া”
নাম দিয়ে দিয়েছে । তাই একটা উপায় বের করে
নিয়েছে ও । প্রতিদিন ভাইয়াকে দেখিয়ে
দেখিয়ে ঝুঁটি করে ভার্সিটিতে আসে আর ঠিক তার
পর পরই ওয়াশরুমে গিয়ে চুল ছেড়ে দেয় । কিন্তু
জমের মত ভয়ঙ্কর ভাইয়াকে কি এসব বলা যায়? তাই
মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে ।
...
যাই হোক , ঝুঁটি ঠিক করে দিয়ে ভাইয়া একটা একহাজার
টাকার নোট ধরিয়ে দিল । তারপর বলল , “আজকে
তো মা দিবস । দুপুরে ভাল কোন রেস্টুরেন্টে
গিয়ে মা-মেয়ে ভাল কিছু খেয়ে নিস । আমার
অফিসে আজকে অনেক চাপ থাকবে । নাহলে
আমিই সময় করে চলে আসতাম । কি ! পারবি তো ?”
“হ্যা পারব।”
ভাইয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু
অবাক হল ত্রিণা । ভাইয়া কোন ফেসবুক টেসবুক
চালায় না । তেমন কোন সোশাল মিডিয়ার সাথেও
যুক্ত না যেখানে ত্রিণা নিজে ফেসবুক টুইটার সব
খুলে বসে আছে । কিন্তু আজ যে মা দিবস এই
ব্যাপারটা ওর আগে ভাইয়াই বলে দিল ! ব্যাপারটা কিরকম
না !
নাহ! এতো নতুন না । বলতে গেলে প্রায়
প্রতিবপছর ভাইয়া এইদিনটা পালন করে এভাবেই ।
এভাবে বলতে , ত্রিণাকে টাকা দিয়ে দেবে অথবা
কোন কোন বছর রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার
কিনে এনে বাসায় দিয়ে যাবে । কিন্তু সরাসরি মাকে
কখনও বলতে দেখা যায় নি “হ্যাপি মাদারস ডে , মা” ।
এক মিনিট ! এই কাজটা ভাইয়া সবসময়ই করে ।
সবধরনের অনুষ্ঠানে ও কেমন জানি পেছনে
থাকতে চায় । মায়ের জন্মদিন এমনকি ত্রিণার নিজের
জন্মদিনগুলোতেও ওর বার্থডে গিফটটা কখনওই
ভাইয়া নিজের হাতে ওকে দেয় নি । সবসময় মা দিয়ে
এসেছে । সবকিছু নিজে করে , কিন্তু কাউকে
বুঝতে দেয় না আসলে ও-ই যে করে এসব ।
কিরকম যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাব ওর । কি
যে সুবিধা আছে এতে , একমাত্র ভাইয়া নিজেই
জানে !
...
যাই হোক , এক্সাইটেড হয়ে ত্রিণা ওর সব
বান্ধবীকে মা দিবসের কথা বলে । সবাই ওর কথা
শুনে এক্সাইটেডও হয় । কিন্তু সেই
এক্সাইটেডনেস ফেসবুকে মায়ের সাথে ছবি
অথবা প্রোফাইল পিকচার আপলোড করা পর্যন্তই
থাকে । এরপর “মা দিবস” বছরের বাকী তিনশো
চৌষট্টি দিনের মতই হয়ে যায় ।
দুপুরে কোনভাবেই মাকে ঘর থেকে বের করা
গেল না । অনেক জোর-জবদ্দস্তি করেও মাকে
বের করতে পারল না ত্রিণা । কারণ একটাই ! তার গুণধর
ছেলেকে ছাড়া তিনি বাইরে খাবেন না । শেষ
পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ভাইয়াকে কল দিল ত্রিণা । একবার
রিং পড়ার সাথে সাথেই কল রিসিভড । এই ব্যাপারটা
সম্পর্কেও একটু না বললেই নয় । বাসায় থাকার সময়ও
অনেকবার দেখেছে ত্রিণা , অনেক গুরুত্বপূর্ণ
কল আসলেও ভাইয়া হেলেদুলে ওগুলো রিসিভ
করে । এমনকি বসের কল হলেও এর ব্যাতিক্রম হয়
না । অনেকসময় তো রিং হয়ে হয়ে কলগুলো
কেটেও যায় । কিন্তু ত্রিণার ব্যাপারটা পুরোই
উল্টো । এপর্যন্ত জীবনে কখনওই ভাইয়াকে
কল করে এক থেকে দুই রিং এর বেশি অপেক্ষা
করতে হয় নি ওকে । বিদ্যুৎ বেগে কল রিসিভ
করে ফেলে ভাইয়া । মাঝেমাঝে বিরক্ত হয় ত্রিণা ।
কারণ ফোনে ব্যালেন্স না থাকলে অথবা কম
থাকলে মিসকলটাও দেয়া যায় না ওকে । পরে যদিও
সাথে সাথেই ফোনে ব্যালেন্স চলে আসে ।
তারপরেও এই একটা “ভাইয়া” নামের পেইনটা ওর
জীবন থেকে আর গেল না ।
...
...
যাই হোক ভাইয়াকে ফোন করে মায়ের সকল
বৃত্তান্ত বলল ত্রিণা । শুনে ভাইয়া এমন একটা সমাধান
বের করল যেটা শুনে ত্রিণার রাগের পরিমাণটা
আরোও বেড়ে গেল । সমাধানটা হল , ত্রিণা এখন
আবার বের হয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসবে । তারপর
মা-মেয়ে বসে ঘরেই লাঞ্চ করবে । কিন্তু
এরপরের কাহিনী শুনে অবশ্য আবার নিজেকে
শান্ত করে রাখল ত্রিণা । কারণ ভাইয়া বলেছে
বিকেলে অফিস থেকে এসে ওরা তিনজন মিলে
শিশুপার্কে যাবে , রাত পর্যন্ত ঘুরবে তারপর বাইরে
খেয়ে একসাথে বাসায় ফিরবে ।
শিশুপার্ক ! ত্রিণার খুব প্রিয় একটা জায়গা । বয়সটা
অনেক বেড়ে গেলেও এখনও এটার প্রতি
লোভ সামলাতে পারে না ও । আর ভাইয়াও জানে
ব্যাপারটা । তাই মোক্ষম সময়ে এই অস্ত্রটা সবসময়
ব্যবহার করে ।
যাই হোক ভাইয়া যেহেতু এক কথার মানুষ , সুতরাং
সেদিন সত্যি সত্যিই যা যা বলেছে সবই করেছে ।
বলা যায় জীবনের অন্যতম একটা সেরা দিন পার
করেছিল ত্রিণা ।
এভাবেই দিনগুলো কাটতে লাগল ভালভাবেই ...
তারপর একসময় রমজান মাস এল । ঈদের অপেক্ষায়
অপেক্ষায় প্রায় অর্ধেক মাস চলেও গেল । ঠিক
এমন সময় হঠাৎ ভাইয়ার অফিস থেকে অর্ডার এল
ভাইয়াকে এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে
হবে । অর্ডার যখন এসেছে তখন তো যেতেই
হবে । মনে মনে একটু খুশিই হল ত্রিণা । যাক অন্তত
এক সপ্তাহের জন্য হলেও ভাইয়ার হাত থেকে
মুক্তি পাওয়া যাবে । কিন্তু এদিকে মা রীতিমত কানাকাটি
শুরু করে দিয়েছে । কিছুই বুঝতে পারল না ত্রিণা ,
জীবনের জন্য তো আর চলে যাচ্ছে না , মাত্র
তো একটা সপ্তাহ । কিন্তু কে শোনে কার কথা ...
যাই হোক , হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে ওঠার আগেই
ভাইয়া ফুরুৎ করে চট্টগ্রাম চলে গেছে ত্রিণার
খেয়ালই নেই । ভাইয়া অবশ্য এরকমই । কখন কি
করে না করে কেউই জানে না একমাত্র মা ছাড়া ।
আচ্ছা মা ছাড়া জানার মত আর আপন কে আছে ?
ত্রিণা নিজেই!
কিন্তু সেই সুযোগ কি ভাইয়া দেয় ওকে ?
নাকি ত্রিণা নিজেই ইচ্ছে করে দূরে সরে থাকে !
অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্ন । ধুর ! এসব বাদ এখন ।
এখন শুধুই মুক্তি আর স্বাধীনতা । প্রথম কয়েকটা
দিন অনেক মজায় কাটাল ত্রিণা । যখন ইচ্ছে তখন
বের হয় , বান্ধবীদের সাথে শপিংএ যায় । কোন
বাধাই নেই বলা যায় । মাঝেমধ্যে মা একটু আধটু
বলে বৈকী কিন্তু মা তো! মেনেজ করে ফেলা
যায় ।
কিন্তু ধীরে ধীরে আনন্দের পরিমাণ কেমন
যেন কমে যেতে লাগল ! ত্রিণা নিজেই বুঝতে
পারল না এর কারণটা কি ! কেমন যেন ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা
লাগতে শুরু করল । বাবা মারা যাবার পর ভাইয়াই একমাত্র
পুরো ঘর সামলে রাখত । কোনদিন বাবার অভাব
বুঝতে দেয় নি ত্রিণাকে । সবসময় সব ধরনের
সমস্যা থেকে ওকে এমনকি মাকেও দূরে
রেখে নিজে নিজে সেটা সমাধান করার চেষ্টা
করত । বাইরে অনেক কঠিন একটা মানুষ হলেও ,
সবার সাথে একটা দূরত্ব রেখে চললেও
ভেতরে ভেতরে কিন্তু ভাইয়া একটা ছোট্ট শিশুর
মতন । এই একটা ব্যাপার ত্রিণা বুঝতে পারে । এজন্যই
মাঝেমাঝে এই অসহ্য মানুষটাকে মিস করে প্রচুর ,
যেমন এখন করছে ...
হাঁটতে হাঁটতে একসময় ভাইয়ার রুমে ঢুকে পড়ল
ত্রিণা । কখনও কোন ব্যাপারে ভাইয়া ওকে
সীমাবদ্ধতা দেয় নি । এমনকি ওর কম্পিউটারের
পাসওয়ার্ডও ত্রিণার জানা । সামান্য অগোছালো রুমটায়
তেমন কিছুই নেই বলা যায় । দেয়ালে একটা ছবি
আছে , তাও মা-বাবার ।
হাঁটতে হাঁটতে কম্পিউটারের কাছাকাছি গেল ত্রিণা ।
কোনকিছু চিন্তা না করেই ওপেন করে বসল সেটা
। ডেক্সটপে ওয়ালপেপারে একটা চৌদ্দ-পনের
বছর বয়সের মেয়ের ছবি । এই মেয়েটাকে
ত্রিণা চেনে । কারণ ও নিজেই এই মেয়েটা ।
“পিকচার” নামের ফোল্ডারটায় সব ত্রিণার ছবি নয়ত
মায়ের ছবি অথবা কয়েকটা বাবার ছবি । কিন্তু ভাইয়ার
নিজের কোন ছবি নেই ।
হঠাৎ ওকে অনেক দেখতে ইচ্ছে হল ত্রিণার ।
পুরো কম্পিউটার ঘেঁটে একটা ছবি বের করা যাবে
, এই চিন্তা প্রথমেই বাদ দেয়ার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু
তারপরেও একবার চেষ্টা করে দেখল , একটা
হলেও যদি পাওয়া যায়...
নাহ! শেষ পর্যন্ত একটা ছবিও পেল না । মাথায় একবার
চিন্তা আসল ভাইয়াকে একটা ভিডিও কল করার ।
কিন্তু কি বলবে কল দিয়ে ?
আর ব্যাপারটা কেমন যেন !
অথবা এই মুহূর্তে ভাইয়া ব্যস্তও থাকতে পারে ,
কে জানে !
তাই এই চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল ত্রিণা ।
তারপর একটা দারুন বুদ্ধি আসল মাথায় । মায়ের থেকে
এলবামটা নিয়ে আসল ও । এটাতে অনেক ছবি আছে
ভাইয়ার । ছোটকালের , বড়কালের সব ছবি আছে ।
অনেক হাস্যকর আর মজার কিছু মুহূর্তের ছবি
আছে । এলবামটা দেখতে দেখতে বুকের উপর
নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল ত্রিণা ...
...
...
আগামীকাল ঈদ । আজকে ভাইয়া আসবে । কোন
ঝামেলা না হলে দুপুর নাগাদ চলে আসার কথা । তারপর
ইফতার করবে সবাই মিলে । মনের মধ্যে কেমন
যেন একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে ত্রিণার ।
কেউ না বলে দিলেও ও জানে ভাইয়া কখনও খালি
হাতে আসবে না । কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই । কি
হতে পারে ! কি হতে পারে ! চিন্তা করতে করতে
কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল খবরই
নেই ।
টনক নড়ল যখন মা এসে বলল ভাইয়াকে একটা ফোন
দিতে কোন আপদ-বিপদ হল কিনা , ইফতারের সময়
তো প্রায় হয়ে এল ।
আপদ-বিপদ ! কি যে বলে মা মাঝেমাঝে । ভাইয়াকে
এখনই একটা ফোন দিলে দুবার রিং পড়ার আগেই
রিসিভ করবে সেই মানুষ ।
এখনই একটা কল দিয়ে মাকে চিন্তা মুক্ত করার জন্য
ত্রিণা মোবাইলটা হাতে নিল । তারপর ভাইয়াকে কল দিল
।
একবার , দুবার , তিনবার , চারবার , এভাবে অনেকবার রিং
হল , কিন্তু কেউই রিসিভ করল না । শেষ পর্যন্ত
কলটা কেটেই গেল । নিজের কানকে যেন
বিশ্বাসই করতে পারল না ত্রিণা । আরেকবার কল করল
ভাইয়াকে । আবার বারবার রিং পড়ে কল কেটে গেল
, কোন উত্তর এল না ...
একটা শীতল রক্তের স্রোত যেন ত্রিণার শিরদাঁড়া
বেয়ে চলে গেল । সারাদিনের রোজায় নাকি
অন্যকারণে কে জানে ! গলাটা শুকিয়ে গেল যেন
ওর ।
জীবনে এই প্রথমবারের মত ভাইয়া কল রিসিভ করল
না ।
কিন্তু কেন?
রাগ করেছে কোন কারণে ?
হতে পারে ও চলে যাবার সময় ওকে বিদায় দেয় নি
, সেজন্য রাগ করেছে । মা বলেছিল , রাতে ভাইয়া
নাকি ওর বিছানার পাশে অনেক্ষণ বসে ছিল । তারপর
যাবার আগে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে একটা
ছোট চুমু দিয়ে চলে গিয়েছিল । চুমু দিলে ত্রিণা
অনেক রাগ করে সেই ছোটকাল থেকেই ।
একবার নাকি ভাইয়া ওকে জোর করে চুমু দেয়াতে
ভাইয়াকে এমনভাবে কামড় দিয়েছিল যে , পুরো
রক্তই বের করে ফেলেছিল । যাই হোক ,
সেদিন ভাইয়ার উপর রাগ হচ্ছিল , কিন্তু এখন কেমন
যেন লাগছে ।
না! ভাইয়ার কিছু হয়নি , এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে
ত্রিণা । কিছু হতেই পারে না । কিভাবে হবে?
কোনভাবেই সম্ভব না !
কোন যুক্তি নেই কিন্তু ভাইয়া ঠিক আছে , এটা
অন্তত ত্রিণা নিশ্চিৎ ...
...
কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার নাম্বার থেকেই কল আসল
ত্রিণার মোবাইলে । পড়িমরি করে কলটা রিসিভ
করেই বলল , “ভাইয়া”
-“না আমি মিস্টার অমিত না । আপনি কি উনার বোন
বলছেন?”
-“জ্বী বলছি”
-“কাইন্ডলি একটু তাড়াতাড়ি মেট্রোপলিটন হসপিটালে
আসুন ।”
-“মেট্রোপলিটন হসপিটাল? কেন? ওখানে কেন?
আর আমার ভাইয়ার মোবাইল আপনার কাছে কেন?”
কিন্তু ততক্ষণে ওপাশ থেকে কল কেটে দেয়া
হয়েছে । কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল ত্রিণা ।
তারপর এই অবস্থাতেই মাকে নিয়ে হাসপাতালের
দিকে রওনা দিল ও ।
...
ঠিক কিসের উপর এসেছে জানে না । আসতে খুব
বেশি হলে দশ মিনিট লেগেছে । কিন্তু ত্রিণার
কাছে এই দশ মিনিট যেন মনে হয়েছে দশ ঘন্টা ।
যাই হোক , হাসপাতালে গিয়ে মাত্রই লোকটাকে
খুঁজে বের করে নিল ত্রিণা । তারপর লোকটা
ওকে আর মাকে সাথে করে নিয়ে একটা বিশাল
রুমে ঢুকল ।
রুমটায় অনেকগুলো মানুষ শুয়ে আছে যাদের
উপরে সাদা কাফনের কাপড় দেয়া । ত্রিণা আর মা ওই
লোকটার পিছন পিছন হাঁটতে লাগল লাশগুলোর মাঝে
।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে লোকটা থেমে গেল ।
একটা লাশের সামনে । তারপর খুব স্বাভাবিকভাবেই
উপরের কাপড়টা সরিয়ে নিল । তারপর ত্রিণা আর ওর
মাকে ওখানে রেখেই ওখানে থেকে চলে
গেল …
খুব শান্ত অবস্থায় ভাইয়া শুয়ে আছে । একদম একটা
ছোট্ট শিশুর মতন । চেহারায় কেমন যেন
একধরনের প্রশান্তি । সেখানে নেই কোন চিন্তা
, নেই কোন রাগ , নেই কোন ধমক । ভাইয়াকে
ঘুমন্ত অবস্থায় খুব কমই দেখেছে ত্রিণা । বাবা মারা
যাবার পর তো ঘুমাতেই দেখে নি ভাইয়াকে বলা যায়
। হয়ত ওর আর মায়ের চিন্তায় চিন্তায় ঘুমাতো না ।
কিন্তু এখন কেন এভাবে ঘুমাচ্ছে ?
সব চিন্তা শেষ?
হঠাৎ করে চিৎকার করে “ভাইয়া , ভাইয়া” করে ডাকা শুরু
করল ত্রিণা । শরীরে যত শক্তি আছে সবটুকু
দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে ডাকতে লাগল । কিন্তু
কিছুতেই কিছু হল না । তারপর হঠাৎ মায়ের দিকে
চোখ পড়ল ওর । একটা মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে
যেন । তারপর পাগলের মত মাকে বলল , “মা, ওমা ,
ভাইয়াকে একটু ডাকো না , আমার উপর রাগ করে
আছে । কথা বলছে না । আমি সরি তো । আর
কোনদিন ঘুমাব না । প্রতিদিন জেগে থাকব । ওমা ,
ডাকো না ভাইয়াকে …”
মা নিরব …
আবার ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করল , “ও ভাইয়া
, একবার তাকাও না । সরি বললাম তো । আর করব না ।
এবারের মত মাফ করে দাও । এই দেখো আমি
চুলে ঝুঁটি করেছি । বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাব
না । তোমার সব কথা শুনব , একবার তাকাও না ভাইয়া ,
ভাইয়া , ও ভাইয়া …”
অনবরত ডেকে যেতেই থাকল ত্রিণা । কিন্তু ভাইয়ার
ঘুম আর ভাঙে না ।
তারপর দুটো মহিলা এসে ত্রিণা আর ওর মাকে নিয়ে
যেতে লাগল । ওরা যেতে চাইল না , তাই জোর
করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল ওদের
। কিন্তু তারপরেও ত্রিণা ভাইয়াকে ডাকা থামালো না ।
ডাকতে ডাকতে একসময় গলাটা যেন ধরে এল ।
চোখদুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসতে
থাকল । আবছা চোখে খালি ভাইয়ার প্রাণহীন নিথর
দেহটা পড়ে থাকতে দেখল ।
…
…
“কিরে দিনের বারটা বাজে , এখনও ঘুমোচ্ছিস , উঠ
উঠ , এতোদিন পর ছেলেটা ঘরে আসবে । আর
তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস ?”
… লাফ দিয়ে উঠল ত্রিণা । সাথে সাথেই বুকের উপর
থাকা ছবির এলবামটা বিছানার উপর পড়ে গেল ।
সেখানে একটা ছবি দেখা যাচ্ছে যেখানে ভাইয়া
ত্রিণাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখে
একটা অমূল্য হাসি নিয়ে ।
খুব ঘেমে গেছে ত্রিণা । এরকম উলটোপালটা
স্বপ্ন গুলো যে কোথথেকে আসে কে
জানে !
যাই হোক , নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে
জিজ্ঞেস করল ,
“মা ভাইয়া কয়টা নাগাদ পৌঁছবে?”
-“কোন ঝামেলা না হলে একটা নাগাদ”
-“ঝামেলা মানে?”
-“আরে কত ধরনের ঝামেলা আছে না ? ওইসব
আরকি !”
-“কিসের ঝামেলা ?”
-“আরেহ পাগলি ! ট্রেন লেট করতে পারে ,
রাস্তায় জ্যাম পড়তে পারে । এসব ঝামেলা আরকি”
-“ওহ!”
কিছু না বলেই ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেল ত্রিণা
।
ত্রিণার হঠাৎ এরকম আচরণে একটু অবাকই হলেন মা ।
তারপরেও কিছু বললেন না ।
...
দুপুর দুটো বেজে পাঁচমিনিট ...
ঘরের একোণা থেকে ওইকোণায় পায়চারী
করছে ত্রিণা । সেই একটা থেকে শুরু করে
এতোক্ষণ পর্যন্ত প্রায় একশো বারের মত
জিজ্ঞেস করেছে মাকে , ভাইয়া কেন আসছে না
। উত্তরে মা ভাইয়াকে ফোন দিতে বলে । আর
তখনই আবার লাফিয়ে উঠে বলে , না ! ফোন দেয়া
যাবে না ।
এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় আড়াইটা বেজে
গেল । এখনও ভাইয়ার কোন খোঁজ নেই । এবার
মা নিজেই ফোনটা হাতে নিলেন , ভাইয়াকে কল
করার জন্য । ত্রিণা আবার লাফিয়ে উঠে মায়ের হাত
থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল , “আমি করছি”
। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ভাইয়াকে ডায়াল করল ...
রিং পড়তে হয়ত দশ সেকেন্ডের মত সময়
লেগেছে , এতোটুকু সময়ের মধ্যেই ত্রিণার
হার্টবিট যেন দশগুণ বেড়ে গেছে ।
একবার রিং পড়ল ,
ত্রিণার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে ,
দ্বিতীয়বার রিং পড়ল ,
ত্রিণা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । তৃতীয়বার আর রিং
এর অপেক্ষা করল না , মায়ের দিকে তাকিয়ে , “ওমা”
বলে আবার ঠাই দাঁড়িয়ে রইল ।
এদিকে মা “কি হয়েছে কি হয়েছে” বলতে পাগল
হবার দশা , কিন্তু ত্রিণার মুখে আওয়াজ নেই ।
...
ঠিক এমন সময়ে দরজা দিয়ে ঢুকলো ভাইয়া । ঢুকেই
ত্রিণার দিকে এগিয়ে এসে বলল , “কিরে ফোন
দিয়েছিলি ? আমি বাড়ির সামনেই ছিলাম । তাই রিসিভ করিনি ,
ভাবলাম এখনই তো দেখা হবে ...”
ভাইয়া কথা শেষ করার আগেই ত্রিণা যেন লাফ দিয়ে
ভাইয়ার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হুহু করে কান্না জুড়ে
দিল । একেবারে ছোট বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে ঠিক
সেভাবেই যেন কান্না করতে লাগল ।
ত্রিণার এমন আচরণে ভাইয়া একটু অবাক হলই বটে
তারপরেও কিছু বলল না । যেন ভাইয়াও বুঝতে পারল ,
কলিজাটাকে সাতদিন দূরে রেখে যাওয়াটা ওর
মোটেও ভাল কাজ হয়নি ...
Like share followers page and subscribe my YouTube channel
https://www.youtube.com/channel/UCfe8n5UGJfqkCNijyYrvHLg/feed
https://www.facebook.com/shimunrube/
ভালোবাসার গল্প