ভালবাসার গল্প বাংলা love story bangla

Wednesday, September 6, 2017

কাজী অফিসে আসার কারন দুটি। প্রথমত আমার আর সাহেদার ডিভোর্স, দ্বিতীয়ত সাহেদা আর আরিফের বিয়ে।

চার বছর সংসার করে আজ আমরা দুজন আবার কাজী অফিসে এসেছি। আজকের কাজী অফিসে আসার কারন দুটি। প্রথমত আমার আর সাহেদার ডিভোর্স, দ্বিতীয়ত সাহেদা আর আরিফের বিয়ে। এমন সময় ঠিক কেমন অনুভুতি হওয়া উচিত তা আমার জানা নেই। তবে আজ যা হতে যাচ্ছে অকল্পনীয় হলেও বাস্তব।
আজ থেকে চার বছর আগে আমার আর সাহেদার বিয়ে হয়। যে সময়টিতে আমাদের বিয়ে হয়, তখন আমরা একজন আরেকজন কে চিনতাম না। পরিবারের পছন্দে আমাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে। এতগুলো বছরে অনেক স্মৃতি জরিয়ে আছে। এর মধ্যে সাহেদা কে আমি অনেক ভালোবেসেও ফেলেছি, তাকে ভালোবাসা টা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, ভালো না বেসে থাকতেই পারিনা। আমি জানি সাহেদাও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আজ সাহেদার থেকেই আমি মুক্তি নিচ্ছি।
আমার এখনো মনে আছে যখন আমাদের বিয়ে হয়, সাহেদা তার কাছে আমাকে যেতে দিতে চায়নি। এক মাস পর্যন্ত সে আমার সাথে এক বিছানাতেও থাকেনি। আমিও সাধারন একটি বেপার ভেবে এড়িয়ে যেতাম, ভাবতাম সে হয়ত এখনো প্রস্তুত না। ধীরে ধীরে তার মন জয় করতে লাগলাম, আমার লুকানো ভালোবাসা তাকে প্রকাশ করতে লাগলাম। সময় যত বয়ে যেতে লাগলো, সাহেদা আমার তত নিকটে আসতে লাগলো। এক সময় সাহেদাও আমাকে ভালোবেসে ফেলে। আর তাকে তো আমি ভালোবেসেছিলাম সেই প্রথম দেখা থেকে।
মৃত্যু যন্ত্রনা আমি দেখেনি, কিংবা কখনো অনুভব করিনি, কিন্তু আজ সাহেদাকে কাজী অফিসে নিয়ে আসার সময় মৃত্যু যন্ত্রনার থেকেও যে ভয়ানক কষ্ট হতে পারে ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হাতে তুলে দিতে আজ আমি তা বুঝেছি। যদিও আমার জানা আছে এই যন্ত্রনা খানিক সময়ের জন্যই। আজকাল সাহেদা আমাকে প্রচন্ড ঘৃনা করে, আমি নিজেই তার সামনে এমন কাজ করেছি যা কখনো কোন নারীই মেনে নিতে পারেনা। রোজ নাইট ক্লাবে মেয়েদের সাথে ফুর্তি করা, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফেরা, এ ছাড়াও সব চেয়ে নিকৃষ্ট যে কাজ করেছি তা আমার স্ত্রী কে চরিত্রহীনা প্রমান করে তাকে ডিভোর্স দিতে যাচ্ছি।
আরিফ আর সাহেদা একই কলেজে পড়ালেখা করতো। কলেজ জীবনে তাদের মাঝে প্রেম হয়, যা সাহেদার পরিবার মেনে নেয়নি আর আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে । সাহেদা আমাকে প্রায় আরিফের কথা বলতো, আমিও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, তাতে যতটুকু জানতে পেরেছি সাহেদার মনের অন্তগভীরে আজো কোথাও না কোথাও আরিফের প্রেমের ফুল ফুটে রয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোন পুরুষ আছে যে নিজ প্রেমিকা, নিজ ভালোবাসা, নিজ স্ত্রীকে অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইবে। কিন্তু আমার এই কাজটি আরো আগেই করা উচিত ছিলো, ভেবেছিলাম আমি ঠিক হয়ে যাবো। কিন্তু আমার ভাবনা আর বাস্তবতা কোনদিন আমাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়েই আজ আমার এই কাজটি করতে হচ্ছে।
ছয় মাস আগে আমি জানতে পারি আমার হৃদয়ের মাঝে একটি ছেদ রয়েছে, যা ধীরে ধীরে আমাকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাচ্ছে। একবার ডাক্তার আমাকে শান্তনা দিয়েছিলো অপারেশন করে হয়ত আমাকে ঠিক করা যাবে। কিন্তু শত চিকিৎসামুলক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারের কথা একটাই, আমার রোগ শেষ পর্যায় আমাকে কোনভাবেই সুস্থ করা যাবেনা।
তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আমার স্ত্রীকে কখনো বিধবার বেশে ধুকে ধুকে জীবন কাটাতে দিবো না। অনেক খোজ করে আরিফের সন্ধান করেছি, এবং সব কিছু জানিয়েছে। সবচেয়ে আনন্দদায়ক যে খবরটি আমার কাছে ছিলো, আরিফ আজো সাহেদা কে ততটাই ভালোবাসে যতটা সে প্রথম যৌবন থেকে ভালোবেসেছিলো। আমার অক্ষমতার কারনে আমাদের কোন সন্তানাদি হয়নি। আর আরিফ আজো সাহেদাকে ফিরে পেতে চায়। আরিফের সাথে বুদ্ধি করেই আমার এই নতুন নাটক সাজানো। আমি সাহেদার চোখে খারাপ হবার কাজ করতাম, আর আরিফ তাকে শান্তনা দিতো, ধীরে ধীরে আমি সাহেদার থেকে দূরে যেতে লাগলাম, আর আরিফ কে সাহেদার কাছে আসার সুযোগ দিলাম। আজকের এই দিনে নতুন এক ইতিহাস রচিত হবে, এক স্বাক্ষরে তালাক, দ্বিতীয় স্বাক্ষরে বিয়ে।
আরিফ সাহেদা আমি তিনজন আরিফের এক বন্ধু কাজী অফিসে দাঁড়িয়ে রয়েছি। অনেক্ষন নিরবতা পালন করে কাজী সাহেব কে বললাম, 
০- কাজী সাহেব আর কতক্ষন। আমাকে বের হতে হবে, তাড়াতাড়ি আমাদের কাজ শেষ করুন।
ততক্ষনে কাজী সাহেবের দলিলপত্র লেখা শেষ, শুধু আমাদের দুজনের স্বাক্ষর বাকী। আমি কোনকিছু না ভেবে স্বাক্ষর দিয়ে সাহেদার দিকে এগিয়ে দিলাম, সে আড়চোখে আমার পানে একবার তাকিয়ে স্বাক্ষর দিলো। আমি সাহেদার চোখে স্পষ্ট আমার জন্য চরম ঘৃনা দেখতে পেয়েছি, যে ঘৃনা কোন নারীই পারে কোন চরিত্রহীন পুরুষকে করতে। সব কথা ভুলে গিয়ে মুখে চিলতে হাসি নিয়ে কাজী সাহেব কে বললাম,
০- আমি জানি তিন মাসের আগে আমি অথবা আমার স্ত্রী বিয়ে করতে পারবনা। কিন্তু কাজী সাহেব আমি আমার স্ত্রীর বিয়ে আরিফের সংগে করাতে চাই, এবং সেখানে স্বাক্ষী হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে চাই। যদিও আমার তিন মাস পর আসা সম্ভব না, তাই আমি আজই স্বাক্ষীর জায়গায় সই দিয়ে যেতে চাই। তিনমাস পর আমার স্ত্রী যখন আরিফকে নিয়ে আসবে বিয়ে করতে তখন যেন আমার স্বাক্ষী দেওয়া কাগজের মাধ্যমেই তাদের বিয়ে হয়।
আগে থেকে কাজীকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিলাম, তাই এখন আর নতুন করে অবাক হলেন না। কিন্তু অবাক হলো সাহেদা, সে প্রতিবাদ করতে যাবে যাবে অবস্থা, নতুবা আমাকে কিছু শোনাতে যাবে, আরিফ তা হতে দিলোনা। আমি আরিফ কে আগেই জানিয়েছিলাম, আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আরিফ যেন কোন কিছু না জানায়। আরিফ সাহেদার হাত চেপে বারন করলো, কিছু জিজ্ঞেস করতে না। কিন্তু এখন সাহেদার চোখে ঘৃনার ছাপ পেলাম না, কৌতুহলের ছাপ পেলাম।
যাই হোক আমি স্বাক্ষীর স্থানে সই করে সোজা আমাদের গ্রামের বাড়ী দিনাজপুর চলে আসলাম। গ্রামে আসতেই আমার শরীর খারাপ হতে লাগলো, দিন যায় আমার অবস্থা বেহাল হয়। তিন মাসের আগেই আমার উপরের টিকেট কনফার্ম হয়ে গেলো। আজ আমার মরনের খবর পৌছে গেছে আমার ভালোবাসা সাহেদার কাছে। সাহেদা আর আরিফ ছুটে এসেছে আমার লাশ শেষবারের মত দেখতে। সাহেদার জন্য আমার লেখা ছোট্ট একটি চিঠি দিয়ে গেলাম, আমার ছোট ভাই রাতুলের কাছে। সাহেদ যখন চিঠিটা পড়বে তখন আমি অনেক দূরে থাকবো এই মোহময় জীবন থেকে অনেক দূরে।
প্রিয় সাহেদা,
আমি জানি তুমি হয়ত আমাকে অনেক ঘৃনা করো, কিন্তু আজ অনুরোধ করছি আমাকে আর ঘৃনা করিও না। মৃত মানুষের উপর নাকি রাগ পুষে রাখতে হয়না। এমন কথা বড়রা বলে। তোমাকে চরিত্রহীন বলার জন্য, আর সবার সামনে ছোট করার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। আমার হৃদয়ে ছেদ ছিলো, যা আমাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করতেছিলো। আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না, আমি চলে যাবার পর তুমি বিধবার বেশে সারাজীবন সন্তানহীন হয়েই কাটিয়ে দাও। আমি জানি তোমার একটি সন্তান কত প্রয়োজন। এতগুলো বছরে আমি এটা জেনে গেছি তুমি মা হবার জন্য সব ত্যাগ করতে রাজী কিন্তু আমার অক্ষমতা কোনদিন তোমাকে মা হবার সুখ প্রদান করবে না।
আমি কোন নেশাবাজ নই, তোমার সামনে মাতাল হবার নাটক করতাম যেন আমাকে তুমি ঘৃনা করো। আর যে সব মেয়েদের সাথে তুমি আমাকে দেখেছো, তাদের সবাইকে টাকা দিয়ে নাটক করিয়েছিলাম, যেন তোমার মন আমাকে ঘৃনা করতে বাধ্য হয়, নতুবা তুমি কোনদিন আমাকে ছেড়ে যেতে চাইতে না তা আমি খুব ভালোকরে জানি।
আরিফের সাথে কয়েকমাস আগে আমার দেখা হয়, ছেলেটা তোমাকে বড্ড ভালোবাসে, এত ভালো তো কোনদিন আমিও বাসতে পারিনি। আজো সে তোমাকে আপন করে পেতে চায়, তোমার কারনে সে আজো বিয়ে করেনি। আরিফের মা বাবা গত হয়েছে বছর দুয়েক হলো, সে আজ সত্যিই একা হয়ে গেছে শুধু কল্পনা করে তার জীবনে তুমি ফিরে আসবে। আমি বেচে থাকতে তোমাকে যে সুখ দিতে পারিনি, মরে যদি দিতে পারি সেটাই আমার জীবনের পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার।
বড্ড সাধ ছিলো তোমার আর আরিফের বিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দেওয়া, কিন্তু আমার জীবন আমাকে সেই সময় দিবে না, তাই আগে থেকেই স্বাক্ষীর জায়গায় সই দিয়ে এসেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও, আর আরিফের সাথে নতুন সংসার করে জীবনে অনেক সুখী হও।
আর একটি কথা, আজ হয়ত তুমি কাদবে অনেক চিৎকার করে কাদবে, তা আমি দেখবো না তোমার চোখের পানিও মুছে দিতে পারবো না, কিন্তু তুমি কাদবে না আমাকে হাসি মুখে বিদায় দাও, আর পরজনম বলে যদি কিছু থাকে আমি তোমার স্বামীই হতে চাইবো। অনেক ভালোবাসা আর শুভকামনা রইলো।
কিছু ত্যাগ কিছু ভালোবাসা এমনি হয় যার কোন অন্ত নেই।


0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment