ভালবাসার গল্প বাংলা love story bangla

Friday, September 22, 2017

এমন একটা পাগল বন্ধুর পাগলামিতে আমরা ক্রমশই ওর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলাম।

“জীবনে সবকিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গেলে কেবল যে কষ্টই বাড়ে, তা নয়... অনেক সময় তা জীবননাশেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়”
.
... এই কথাটা যেমন দিবালোকের মতো সত্য, ঠিক তেমনি এই কথাটাও...
“কালবৈশাখী ঝড় কে ঘণ্টাখানেক সময় দেওয়া হলে, খুব সহজেই সে হাজার বছর ধরে বেড়ে উঠা একটি চঞ্চল গ্রামকে শান্ত করে দিতে পারে”
আমার খুব চঞ্চল একটি বন্ধুর নাম ছিল নিবিড়।
.
বন্ধুদের আসরে সে সবাইকে নাচিয়ে ছাড়ত। ওকে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আনতে বলা হলে, সে সিগারেটের ফিলটার পাশটায় আগুন ধরিয়ে এনে বলত, “এই নে, অনেক কষ্ট করে ধরিয়েছি। এখন প্রানখুলে টান”। তখন এমন একটা ভাব নিয়ে দাঁড়াত যেন রাজা হয়ে কোন প্রজার মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে... ব্যাস, তখনি শুরু হয়ে যেত ম্যাট্রিক্স মুভির মতো ঐতিহাসিক যুদ্ধ।
.
সে প্রায়ই একটা কাজ করত। আমরা বন্ধুরা যখন ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ধরে ল্যাব শেষে ক্লান্তবদনে হলের দিকে রওয়ানা দিতাম, তখনি হঠাৎ আমাদের মধ্যে কেউ একজন গর্জে উঠত। পিছনে ফিরে দেখতাম, নিবিড় চুপি চুপি এসে সজোরে ঐ বেচারার পাছায় লাথি বসিয়ে দিয়ে বলছে... “অই শালারা! আমারে ফালাইয়া তোরা কই যাস?” কিন্তু তখনি নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সত্যতা রক্ষার্থে, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শুরু হয়ে যেত ম্যাট্রিক্স.!
.
পার্ট-২...
আরেকবার হল কি? সেই রকম সর্দিকাশি সমান তালে আমার নাক ও গলার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারছি না, নিবিড় এসে বলল, “ কিরে? ঘুম থেকে উঠবি না? কারে নিয়া এতো স্বপ্ন দেখস? বাদ দে ঐসব। আজকে ফার্স্ট ক্লাস তো তোর হৃদয় উতলা করা ম্যাডামের। জলদি রেডি হয়ে নে”।
আমার অবস্থা খুব খারাপ, নাক ও গলারন্ধ্র নিরেট হয়ে গেছে... নিজের কথা নিজেই শুনতে পারছিলাম না। যাই হোক, খুব কষ্টে ওকে আমার অবস্থা বুঝালাম। ও কিছু না বলে ১ জগ বরফতূল্য ঠাণ্ডা পানি এনে সরাসরি আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে অনর্গল বলতে লাগল, “আরে পড়স নাই? সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কাটাকাটি। তুই এখন সুস্থ, তাড়াতাড়ি ক্লাস করতে আয়”- বলেই ও ক্লাসের দিকে ছুট। আমি ম্যাট্রিক্স."
.
পার্ট ৩
রচনার কাজ হাতে নিলেও পর্যাপ্ত অর্থের(শক্তির) অভাবে মুভিটি মুক্তি পায় নি।
এমন একটা পাগল বন্ধুর পাগলামিতে আমরা ক্রমশই ওর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমরা জানতাম না যে, নদীর কাজই হল ধীরে ধীরে তীর ভেঙে নিয়ে যেতে চাওয়া... এতেই তার সৌন্দর্য নিহিত। আর যে নদী সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে আর জীবিত থাকে না, হয়ে যায় মৃত।
হঠাৎ করেই ও কেমন যেন বদলে যেতে থাকল। রুমে একা একা ঝিম ধরে বসে থাকে। ক্লাস করে সোজা রুমে এসেই ঘুম। সারা রাত হলের ছাদে গিয়ে বসে থাকে। কেমন যেন এক গভীর চিন্তামগ্নতা। কিছু জানতে চাইলেও কিছু বলে না। ঠিক যেন এক সর্বনাশী কালবৈশাখী আমার চঞ্চল বন্ধুকে গ্রাস করে ফেলছে।
.
একদিন বিকেলে ওর মোবাইলে কল দিয়েই যাচ্ছি কিন্তু ও ধরছে না। ছাদে গিয়ে দেখি, চুপচাপ রেলিং এ বসে কি যেন ভাবছে। আমি কিছু না বলে ওর পাশে গিয়ে বসি। ও আমার দিকে তাকিয়ে খুব কষ্টে সৌজন্য রক্ষার্থে একটা হাসি দিল। আসলে হাসি নয়- বাহ্যিকভাবে অধরদুটো বাঁকানোর চেষ্টা।
কিছুক্ষণ পর আমি নীরবতা ভেঙে দিয়ে বললাম, “ আমাকে কি কিছুই বলা যায় না?”
ও খানিকক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ কম্পন বলতে কি বুঝায়, জানিস?”
ও দূরে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবে নিল। তারপর বলল, “একটা মেয়ে আর আমার হৃদয় কম্পন”- বলেই ও চলে গেল। আমি ওর মতো দূরে তাকিয়ে কিছু বুঝার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
রাত ১০টা। পরদিন ক্লাস টেস্ট ছিল। আমি পড়ছিলাম। হঠাৎ করে ও রুমে ঢুকল। চুপচাপ গিয়ে ওর পি,সি, অন করল।
.
আমার কাছে এসে বলল, “তোর পেনড্রাইভটা দে তো, একটা ফাইল ট্রান্সফার করব”। আমি কিছু না বলে তাই করলাম। দেখলাম, ও পেনড্রাইভ পি,সি, তে লাগাল, কিছুক্ষণ পর ওটা খুলে ওর ড্রয়ারে তালা দিয়ে রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল... আমি পিছন থেকে ওকে ডাকলাম, “ নিবিড়! কই যাস এতো রাতে? কালকে ক্লাস টেস্ট, পড়তে বস”। ও আমার কথা কানেই নিল না।
“তোর পেনড্রাইভটার খুব প্রয়োজন অনুভব করলে তালা ভেঙে নিয়ে নিস্”- বলেই ও বেরিয়ে গেল। আমি হা করে ওর চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
পরদিন ওকে আর ভার্সিটিতে দেখলাম না, ভাবলাম বাসায় চলে গেল কিনা? ওর বাসায় ফোন করব কিনা? ফোন করেই বা কি বলব? এইসব ভাবতে ভাবতে ৩ দিন কেটে গেল। বড্ড একা হয়ে গেছি আমি। এখন কেউ আমাদের আর জ্বালায় না, কেউ খাবার কেড়ে নেয় না, কেউ ইচ্ছা করে মারামারি করতেও আসে না। শুধুমাত্র ঐ একটা চঞ্চল নিবিড় শান্ত হয়ে যাওয়ায় আমরাও যেন মরা নদীর ন্যায় হয়ে গেছি।
.
এক সপ্তাহ হয়ে গেল, ওর কোন খোঁজ না পেয়ে ওর বাবাকে খবরটা জানাই। ওর ফ্যামিলিও ওর ব্যাপারে কিছু জানে না। তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেন কিন্তু কোন হদীস পেলেন না।
এক মধ্যরাতে ওকে নিয়ে একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম, হঠাৎ তখন ঘুম ভেঙে গেল। ওর বিছানাটার দিকে তাকালাম- শূন্যতা বিরাজমান। বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠল। ওর টেবিলের ড্রয়ারের দিকে চোখ যেতেই আমার পেনড্রাইভটার কথা মনে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ তালা ভেঙে পি,সি, তে পেনড্রাইভটা লাগালাম। দেখলাম, একটা মাইক্রোসফট ডকুমেন্ট ফাইল। ফাইলটাতে যা লিখা ছিল...!"
“বন্ধু! মেয়েটার নাম রিনি। আমি ওর কথা পৃথিবীর কাউকে জানাতে চাই না। শুধু তোকে বললাম। ও কেমন সুন্দরী ছিল তা নিয়ে আমি হাজার হাজার পাতা খরচ করতে পারব। ওর প্রসঙ্গে আমি শুধু তোকে একটা কথাই বলব... কিছু চোখ হয় মায়াবিনী, কিছু ঠোঁট হয় আরক্তিম, কিছু চুল হয় স্বর্গীয় লতা আর কিছু হৃদয়?...
দোস্ত! আমি জানি না, স্বর্গসুখ কি জিনিস? কিন্তু এতোটুকুন জানি যে, তার হৃদয়স্পর্শ পৃথিবীর সকল সুখের ঊর্ধ্বে।
.
দোস্ত! আমি ওকে ভালবাসতাম কিনা জানি না, কিন্তু এতটুকু জানি যে, ওকে আমার করে নেওয়ার চেয়ে আমি চাইতাম ও যেন কখনও আমার কাছ থেকে হারিয়ে না যায়।
ওর খুব সখ ছিল ও আমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকবে, আর আমি গিটারে টুং টাং করে ওকে গান শোনাবো। ও প্রায়ই বলত, “ ইস্! আমাকে যদি কেউ বাইকের পিছনে নিয়ে আমার সাথে কিছুটা সময় কাটাত!”...
.
বন্ধু! আজও মরার আগে খুব ভালো একজন গিটারিস্ট আর বাইক রেসার হওয়ার স্বপ্ন দেখি।
জানিস দোস্ত! একটা উক্তি প্রায়ই আমার মাথাটায় ঘুরপাক খেত...
“ If you succeed in cheating someone, don’t think that that person is a fool but you should realize that that person trusted you much more than you deserved”
দোস্ত! প্লিজ... ওকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি এখনও হিসাব মিলাতে পারি নি যে কে, কার সাথে চিটিং করেছে। আমি তার সাথে নাকি সে আমার সাথে? আমার খাটের নিচে তাকালেই তুই বুঝতে পারবি।
ভালো থাকিস দোস্ত”।।
খাটের নিচে তাকিয়ে দেখি শতখানেক A4 কাগজ ছড়ানো-ছিটানো। সবগুলোতেই লিখা, “WHO IS THE RIGHT ONE? YOU OR ME?”
আমি খুব ভালভাবেই জানি আমার আহত বন্ধুটি ঐ মেয়েটিকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু কথা হল... ও নিখোঁজ আজ প্রায় ২ বছর। এর মধ্যে ওর মা কম করে হলেও ২০ বার আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। প্রত্যেকবারই দেখতাম তিনি হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন... আমাকে দেখেই অশ্রুসিক্ত নয়নে ওড়নার বর্ধিত অংশ দিয়ে মুখটা চেপে রেখে বলতেন... “আমার নিবিড়?”
পৃথিবীর সব কিছু সহ্য করা যায় কিন্তু ছেলের জন্য মায়ের সেই নিষ্পাপ ভালবাসায় সিক্ত আঁখিদুটি, আমি কেন? বোধ করি কেউই সহ্য করতে পারবে না।এখন কিছুটা হলেও বুঝি, কালবৈশাখী কতটা হিংস্র হলে নিবিড় নামের একটি চঞ্চল ছেলেকে এভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে, তাকে মায়ের আদর ভুলিয়ে দিতে পারে, খুব কাছের বন্ধুদের সাথে মারামারি করার তীব্র মজাটুকু মন থেকে মুছে দিতে পারে। আমি আজও জানি না সে কোথায়, কিভাবে আছে, কিংবা... ? হুহ... যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস বন্ধু। আজও হয়তো আমার বন্ধু নিবিড় রিনিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে নিবিড়ভাবে ভালোবাসে, নিবিড়ভাবে ভালোবাসে তার মাকে, তার বাবাকে, হয়তোবা আমাকেও।
.
আমার কলম আর এগুতে চাচ্ছে না। ও আমাকে প্রায়ই একটা কথা বলত... “দোস্ত! দেখিস, আমার মা-বাবার আগে আমি মারা যাব, এমনকি আমি তোর আগে মারা যাব। কারণ আমি মরলে তোরা আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবি, কিন্তু তোদের হারানোর কষ্ট আমি কখনই সহ্য করতে পারব না”...
.
নিবিড় হয়তো সত্য কথাটাই বলেছে। তাই যেই সত্য কথাটি দিয়ে গল্পটা শুরু করেছিলাম, সেই কথাটি দিয়েই শেষ করতে চাই...
“জীবনে সবকিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গেলে কেবল যে কষ্টই বাড়ে, তা নয়... অনেক সময় তা জীবননাশেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়”!
.
→Nistobdo Ovimani Hridoy (অভিমানী মেঘ বালক)

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment